ইইজি রিপোর্ট নিয়ে ব্যবসা ও প্রতারণা – দেখার কেউ নেই
ইলেক্ট্রোএনসেফ্লোগ্রাম (মস্তিষ্কের বৈদ্যুতিক লেখচিত্র )
(Electroencephalography সংক্ষেপে) একটি তাড়িত শারীরবৃত্তীয় পর্যবেক্ষন পদ্ধতি যা দ্বারা মস্তিষ্কের বৈদ্যুতিক সক্রিয়তা লিপিবদ্ধ করা হয়। ইইজি একটি পেইন লেস বা ব্যথাহীন প্রসিডিওর যেখানে ইলেকট্রোডস (একটি ছোট মেটাল এর তৈরী ডিস্ক বা ধাতব চাকতি) যা মাথার উপরি ত্বকে লাগানো থাকে, ব্রেইনের ইলেক্ট্রিক্যাল অ্যাক্টিভিটি বোঝার জন্য ব্যবহৃত হয়। মস্তিস্কের সেল বা কোষ গুলি ছোট ছোট বৈদ্যুতিক তরঙ্গের মাধ্যমে যোগাযোগ স্থাপন করে এবং আমরা ঘুমিয়ে গেলেও এই বৈদ্যুতিক তরঙ্গ সক্রিয় থাকে। মস্তিস্কের এই বৈদ্যুতিক তরঙ্গের ক্রিয়া কতগুলি তরঙ্গায়িত লাইনের মাধ্যমে EEG রেকর্ডিং –এ দেখা যায়। বৈদ্যুতিক মস্তিষ্ক লেখচিত্রন পরিমাপ করা হয় নিউরন এবং মস্তিষ্কের আয়নিক বিদ্যুৎ প্রবাহের ভোল্টেজ ওঠানামা দ্বারা। এপিলেপ্সি রোগ নির্নয়ের জন্য এটি প্রধান টেস্ট এছাড়া মস্তিস্কের বিদ্যুৎ প্রবাহের কোন অস্বাভাবিকতা থাকলেও এই টেস্ট করা হয়ে থাকে। অবচেতন অবস্থার গভীরতা (কোমা), এনসেফালোপ্যাথি (বিভিন্ন কারনে ব্রেইন বা মস্তিস্ক ঠিক ভাবে কাজ করে না, এনসেফালাইটিস (ব্রেইনের ইনফ্লেমেশন বা প্রদাহ, এনসেফালোপ্যাথিস, মস্তিষ্কের মৃত্যু এসব নির্ণয় করার জন্য ইইজি ব্যবহার করা হয়। টিউমার, স্ট্রোক এবং কেন্দ্রীয় মস্তিষ্কের অন্যান্য অস্বাভাবিকতা নির্নয়ে এম আর আই এবং সিটি স্ক্যান ফার্স্ট লাইন পদ্ধতি হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
জার্মানির শারীরবিজ্ঞানি এবং মানসিক রোগের চিকিৎসক হ্যানস বার্গার প্রথম মানুষের মস্তিষ্ক লেখচিত্রন লিপিবদ্ধ করেন ১৯২৪ সালে। রিচার্ড ক্যটোন এবং অন্যান্যদের, প্রানীর উপর আগের কাজের বিস্তৃতের ভিত্তিতে, বার্গার ইলেক্ট্রোএন্সেফালোগ্রাম (বৈদ্যুতিক মস্তিষ্ক লেখচিত্রন এর যন্ত্র) আবিষ্কার করেন, যা ক্লিনিকাল নিউরোলজির ইতিহাসে সবচেয়ে বিস্ময়কর,অসাধারণ এবং গুরুত্বপুর্ণ উন্নয়ন হিসেবে বিবেচিত। তার আবিষ্কার সর্বপ্রথম নিশ্চিত এবং উন্নত করেন ব্রিটিশ বিজ্ঞানী এডগার ডগ্লাস আদ্রিয়ান এবং বি.এইচ.সি ম্যাথিউস ১৯৩৪ সালে।
১৯৩৪ সালে ফিশার এবং লনব্যাক প্রথম মৃগীরোগের পাঠ প্রদর্শন করেন। গিবস, ডেভিস এবং লেনক্স ইন্টেরিকটাল (খিচুনির মাঝামাঝি অবস্থা) এর তরঙ্গ এবং ক্লিনিকাল এবসেন্স সিযার এর বিশ্লেষন করে, যা ক্লিনিকাল ইইজি ক্ষেত্রটি শুরু করে। পরবর্তীকালে, ১৯৩৬ সালে গিবস এবং জ্যাসপার ইন্টেরিকটাল স্পাইক কে মৃগীরোগের কেন্দ্রীয় সিগনেচার হিসেবে জ্ঞাপন করেন। একই বছর, প্রথম ইইজি ল্যাবোরেটরি খোলা হয় ম্যাচাচুসেটস জেনারেল হাসপাতাল এ।
১৯৪৭ সালে, আমেরিকান ইইজি সোসাইটি সংস্থাপিত করা হয় এবং ইন্টান্যাশনাল ইইজি মহাসভা সংঘটিত হয়েছিলো।
কীভাবে EEG এর জন্য প্রস্তুতি নিতে হয়?
- EEG টেস্ট করার ঠিক আগের দিন মাথা ভাল করে ধুত্তে হবে কিন্তু কোন জেল, ক্রীম, কন্ডিশনার বা স্প্রে চুলে ব্যবহার করা যাবে না।
- টেস্টের ৬ ঘণ্টা আগে থাকে কোন ক্যাফিন জাতীয় খাবার খাওয়া যাবে না।
- চিকিৎসক মানা না করে থাকলে রোজকার ওষুধ খেতে পারেন।
- আপনাকে যদি EEG টেস্টের সময় ঘুমোতে হয় তাহলে চিকিৎসক আম্নাকে টেস্টের আগের দিন কম ঘুমানোর এমনকি ঘুমোতে মানাও করতে পারেন। টেস্টের সময় যদি তাও ঘুম না আসে তাহলে চিকিৎসক সিডেটিভ ওষুধ দিতে পারেন
ইলেকট্রোসেফালোগ্রাম (EEG) প্রসিডিওর এর পর কী হয়?
EEG টেস্টের পর টেকনিশিয়ান ইলেকট্রোডস বা ক্যাপ গুলি সড়িয়ে দেন। যদি কোন সিডেটিভ না দেওয়া হয়ে থাকে তাহলে টেস্টের পর কোন পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হয় না ও স্বাভাবিক কাজ কর্ম করা যায়। কিন্তু টেস্টের সময় কোন সিডেটিভ ওষুধ দেওয়া হলে সাধারণত ১ ঘণ্টা সময় লাগে ওষুধের প্রভাব কাটতে। এবং সেক্ষেত্রে আপনাকে বাড়ি নিয়ে যাওয়ার জন্য কোন কাউকে সাথে থাকতে হবে। সেই দিনটা বিশ্রাম নেওয়া উচিত ও গাড়ি চালানো বা ড্রাইভ করা কখনই উচিত নয়।
নিউরোলজিতে সবচেয়ে বেশি যে পরীক্ষাটি ভুল রিপোর্ট দেয়া হয় সেটি হল ইইজি। ইইজি রিপোর্ট করতে হয় ট্রেনিং করা বিশেষজ্ঞের মাধ্যমে। লজ্জার বিষয় আমাদের এই চট্টগ্রামে সিংহভাগ ইইজি রিপোর্ট তৈরী করে দেন টেকনিশিয়ানরা এবং বিশেষজ্ঞরা এতে সাইন করেন। আশ্চর্যের ব্যাপার যার সবকটি রিপোর্ট লিখা হয়ে থাকে Seizure Disorder (সিজার ডিজঅর্ডার) বা GTCS (খিচুনি রোগ)। ফলে এই ভুল রিপোর্টের কারণে একজন সুস্থ-সবল লোক খিচুনির ওষুধ খাচ্ছেন দীর্ঘদিন ধরে। Indication ছাড়া ইইজি লেখা হচ্ছে হরহামেশা। মনে হচ্ছে দেখার কেউ নেই। অনেক ক্ষেত্রে ডাক্তাররা সামান্য রিপোর্ট ফী নিয়ে খুশি থাকেন এবং প্রতিবাদ করেন না। সাধারণ মানুষ হিসেবে এখন সময় এসেছে এই অন্যায়, অযুক্তিক অপ্রয়োজনীয় পদ্ধতিটিকে পরিবর্তনের এবং আমরাই পারবো।